mymensingh bd news24 :
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্ম ও কীর্তি দিয়ে গড়েছেন বাঙালির ইতিহাস। তাঁর নেতৃত্বেই স্বাধীনতার জন্য তৈরি হয় বাঙালি জাতি। এরপর নয়মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ।
এই স্বাধীন রাষ্ট্র এমনিতেই আসেনি। এ জন্য বঙ্গবন্ধুকে আন্দোলন-সংগ্রামের দীর্ঘ পথপরিক্রমা অতিক্রম এবং অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। কারাগারে কাটাতে হয়েছে ৪ হাজার ৬৮২ দিন। (সূত্র : সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের সংসদে প্রদত্ত বক্তব্য, দৈনিক প্রথম আলো, ৮ মার্চ ২০১৭।) এই দীর্ঘ কারাজীবন ৩৬৫ দিন দিয়ে ভাগ করলে দেখা যায় তিনি জেলে ছিলেন প্রায় তেরো বছর।
ঘাতকরা তাঁকে ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট সপরিবারে যখন হত্যা করে তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ৫৫ বছর। ৫৫ বছর থেকে কৈশোরের ১৮ বছর বাদ দিলে থাকে ৩৭ বছর। এই ৩৭ বছরের মধ্যে প্রায় ১৩ বছর কারাগারে কাটান শেখ মুজিবুর রহমান। তাই খুব সহজেই বলা যায় বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বাসস্থান ছিল ‘কারাগার’।
বঙ্গবন্ধুর কারাগার জীবনের কিছু অংশ আছে তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে। এরপর প্রকাশিত হয় ‘কারারাগারের রোজনামচা’ শীর্ষক গ্রন্থ। ১৯৬৬ সালে বাঙালির মুক্তির সনদ ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি উত্থাপনের পর ওই বছরেই প্রথম তিন মাসে তিনবার গ্রেফতার এবং জামিন পান বঙ্গবন্ধু।
এরপর মে মাসে আবারও গ্রেফতার হন। সেই সময়কার জেলে বন্দিজীবনের দিনলিপি রয়েছে কারাগারের রোজনামচায়। কারাগারের দিনলিপি এবং বঙ্গবন্ধুর অন্য দুটি বক্তব্যে ১৯৭১ সালের ২০ নভেম্বর পাকিস্তানের কারাগারে বন্দিজীবনের ঈদসহ মোট ৭টি ঈদ জেলে পালনের তথ্য পাওয়া যায়। যেখানে পরিবার-পরিজন এবং নেতাকর্মীদের ছাড়া জেলের নিরানন্দ ও দুঃখময় ঈদের বাস্তবতা ফুটে ওঠে।
পরিবার-আত্মীয়স্বজন ছাড়া জেলের ঈদ কেমন―সেটা কারাবন্দিরাই জানেন। আর জানে কারাবন্দির স্বজনরা। বঙ্গবন্ধু কারাগারে থাকায় ঈদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত ছিলেন স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েরাও। দুঃসময়ের ঈদের মর্মন্তুদ বয়ান বঙ্গবন্ধু লিখেছেন তাঁর কারাগারের দিনপঞ্জিতে। ১৯৬৭ সালের দিনপঞ্জিতে তিনি লেখেন, ‘…১১ তারিখ রেণু এসেছে ছেলেমেয়ে নিয়ে দেখা করতে। আগামী ১৩ই ঈদের নামাজ। ছেলেমেয়েরা ঈদের কাপড় নেবে না। ঈদ করবে না, কারণ আমি জেলে। ওদের বললাম, তোমরা ঈদ উদযাপন করো। … ছেলেমেয়েদের মুখে হাসি নেই। ওরা বুঝতে শিখেছে। রাসেল ছোট তাই এখনো বুঝতে শিখে নাই। …ওদের কাছ থেকে বিদায় নেবার সময় রেণুকে বললাম, বাচ্চাদের সবকিছু কিনে দিও। ভাল করে ঈদ করিও, না হলে ওদের মন ছোট হয়ে যাবে। (শেখ মুজিবুর রহমান, কারাগারের রোজনামচা, পৃষ্ঠা : ২০১)
বাবা ছাড়া সন্তানদের ঈদ কতটা বিষাদের তা বুঝতেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। তাই তো বেগম মুজিবকে বলে দেন ঈদে যা যা দরকার তা যেন ছেলেমেয়েদের কিনে দেন। সন্তানরাও গভীরভাবে বুঝেছেন জেলে বাবার বন্দিজীবনের বাস্তবতা। কারণ তারা গড়ে উঠেছেন বাবার আদর্শেই। যে বাবা জেলে খেয়ে-না খেয়ে ঈদ করবেন সেই বাবার সন্তানরা কী আনন্দঘনভাবে ঈদ করতে পারেন? তাই বাবার প্রতি সহমর্মিতা ও শ্রদ্ধা-ভালোবাসা রেখে নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন যে, ঈদে নতুন কাপড় নেবেন না তারা। এ ঘটনায় বাবা-সন্তান পরস্পরের প্রতি যে মমত্ববোধের গভীরতা―তাই ফুটে ওঠে।
এটি ছিল ১৯৬৭ সালের ঈদুল ফিতর (রোজার ঈদ)। ঈদের দিন বঙ্গবন্ধুর পায়ে ব্যথা ছিল। অনেক কষ্ট করেই নামাজে যান তিনি। এই সুযোগে তাঁর প্রাণপ্রিয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে দেখা হয়। তবে এই ঈদ বাঙালিদের প্রকৃত ঈদ ছিল না। পুরো বাংলায় আইয়ুব খানের অপশাসন-শোষণে জর্জরিত। বাঙালি মুসলমানের সকল অধিকারই খর্ব করেছে অবৈধভাবে শাসনভার দখল করা এই সামরিক জান্তা। তাই অবরুদ্ধ বাঙালি মুসলমানের ঈদ তো আসলে ঈদ নয়, একটা আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। দিনপঞ্জিতে সেই কথাও উল্লেখ করেন বঙ্গবন্ধু।
কারাগার থেকেই দেশবাসী ও সহকর্মীদের জানাই ঈদ মোবারক। পূর্ববাংলার সেই দিনই ঈদের আনন্দ ভোগ করতে পারবে, যেদিন তারা দাসত্ব থেকে মুক্তি পাবে, এবং দেশের সত্যিকারের নাগরিক হতে পারবে। (কারাগারের রোজনমাচা, পৃষ্ঠা : ২০২
সেবছর কোরবানির ঈদ হয়েছিল ২২ মার্চ, বুধবার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখনো জেলে। পরবর্তী ঈদগুলো কি জেলে করতে হবে, নাকি মুক্তি পাবেন―তারও কোনো নিশ্চয়তা বা আভাস নেই। এরমধ্যে তাঁর নামে ঢাকায় পাঁচটি মামলার পরও সরকারের পক্ষ থেকে চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ, নোয়াখালী, পাবনা ও যশোরে আরও ছয়টি মামলা দায়ের করা হয়। আইয়ুব সরকার যে তাঁকে এবার বড় পরিকল্পনা নিয়েই জেলে বন্দি করেছে তার আভাসই পাওয়া যায় এই মামলাগুলোর মাধ্যমে।
এমন বাস্তবতায় কোরবানির ঈদ উদযাপন নিয়ে অনেকটা আবেগীই হয়ে উঠেন বঙ্গবন্ধু। কয়েদি জীবনের ঈদ নিয়ে বিরক্তও ছিলেন তিনি। অপ্রত্যাশিত ঈদের কথাই ধরা পড়েছে তাঁর স্মৃতিকথায়।
গত ঈদেও জেলে ছিলাম। এবারও জেলে। বন্দিজীবনে ঈদ উদযাপন করা একটি মর্মান্তিক ঘটনা বলা চলে। বারবার আপনজন, বন্ধু-বান্ধব, ছেলেমেয়ে, পিতামাতার কথা মনে পড়ে। ইচ্ছা ছিল না নামাজে যাই।… কয়েদিদের কি নামাজ হয়! আমি তো একলা থাকি। আমার সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক বন্দিকে থাকতে দেয় না। একাকী কি ঈদ উদযাপন করা যায়? জেলার সাহেব নামাজ বন্ধ করে রেখে আমাকে নিতে আসেন। তাই যেতে বাধ্য হলাম।’ (কারাগারের রোজনমাচা, পৃষ্ঠা : ২১২―২১৩)
১৯৬৮ সাল। শেখ মুজিবুর রহমানসহ রাজবন্দিদের মুক্তির দাবিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিং হচ্ছে। এর কিছুদিন পর আরেক ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় জড়ানো হয় তাঁকে। অবশ্য এই ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে তিনি আগেই টের পান। ১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি গভীর রাতে শেখ মুজিবুর রহমানকে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। কিন্তু কারাগারের গেট দিয়ে বাইরে এলে তাঁকে সেনাবাহিনীর সদস্যরা বন্দি করে নিয়ে যায় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে। তাঁকে জড়ানো হয় আগরতলায় গিয়ে পাকিস্তানকে ভাঙ্গার ষড়যন্ত্রের মামলায়। আগরতলা মামলা এমন সময় করা হয় যখন শেখ মুজিবুর রহমানের প্রস্তাবিত ছয় দফাভিত্তিক আন্দোলন এবং শেখ মুজিবসহ রাজবন্দিদের মুক্তির দাবিতে পূর্বপাকিস্তানে পুরো বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ।
এই মামলার উদ্দেশ্য ছিল ছয় দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন দাবির আন্দোলন ও বন্দিদের মুক্তি প্রহসনের মাধ্যমে নস্যাৎ করে দেওয়া। এরমধ্যে জেলে বন্দি চট্টগ্রামের এক আওয়ামী লীগ কর্মীকে রিমান্ডে অমানবিক নির্যাতন করে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষী দিতে বাধ্য করা হয়। বঙ্গবন্ধু সেই কথা জানতে পারেন জেলে ঈদের নামাজে গিয়ে। স্মৃতিকথায় তিনি লেখেন,ডিসেম্বর মাস থেকে অনেক সামরিক, সিএসপি ও সাধারণ নাগরিক গ্রেফতার হয়েছে দেশরক্ষা আইনে―রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা উপলক্ষে, সত্য মিথ্যা খোদাই জানে! প্রথম খবর পাই জেলের মধ্যে ঈদের নামাজে। এই দিন বিভিন্ন ওয়ার্ডের কয়েদিরা কিছু সময়ের জন্য এক জায়গায় নামাজ পড়তে জমা হয়।
আমাকে দেখে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগের কর্মী কেঁদে ফেলে এবং বলে তাঁকে ২১ দিন পুলিশ কাস্টডিতে রেখেছিল। মেরে পা ভেঙ্গে দিয়েছে। … আমাকে জড়াইয়া ধরে কেঁদে দিয়ে বলল, শুধু আপনার নাম বলবার জন্য আমাকে এত মেরেছে, সহ্য করতে পারি নাই বলে যা বলেছে তাহাই লিখে দিয়ে এসেছি। আমি তাকে সান্ত্বনা দিলাম আর বললাম, আল্লাহর ওপর নির্ভর কর। যা হবার হবেই।’ (কারাগারের রোজনমাচা, পৃষ্ঠা ২৫২―২৫৩)
৬টি ঈদ গিয়াছে
আগরতলা মামলার বিরুদ্ধে বাঙালিরা ধারাবাহিকভাবে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করে। তৎকালীন পূর্ববাংলায় গণআন্দোলন হয়, যা একসময় অগ্নিরূপ ধারণ করে, সৃষ্টি হয় উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান। গণআন্দোলনের তোপে শেখ মুজিবুর রহমানসহ আগরতলা মামলার সকল আসামিকে ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি মুক্তি দিতে বাধ্য হয় আইয়ুব খান সরকার। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে শেখ মুজিবুর রহমান একটানা সবচেয়ে বেশিদিন কারাভোগ করেন এ সময়। ১৯৬৬ সালের ৮ মে গ্রেফতার হয়ে ১৯৬৯ সালে ২২ ফেব্রুয়ারি মুক্তি লাভের আগপর্যন্ত ১ হাজার ২১ দিন কারাগারে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। (সূত্র : তোফায়েল আহমেদের সংসদে প্রদত্ত বক্তব্য।) মুক্তি লাভের পরদিন ২৩ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমানকে বিশাল জনসমুদ্রে গণসংর্ধনা দেওয়া হয়। সংবর্ধনা মঞ্চে ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি প্রদান করলে উপস্থিত লক্ষাধিক জনতা তা সমর্থন করেন।
বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ এই কারাজীবনের ফল ছিল ঐতিহাসিক এবং এর প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এরমাধ্যমে হয়ে উঠেন বাঙালি জাতির একক কণ্ঠস্বর, সকল আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক; দৈহিকভাবে একজন ব্যক্তি হলেও পুরো জাতির প্রতিনিধি হন তিনি। ছয় দফার কারণে কারাবরণের পরিপ্রেক্ষিতে বাঙালি জাতির ইতিহাসের মোড় ঘুরে যায়। বাঙালি পদার্পণ করে মূল লক্ষ্য স্বাধীনতা অর্জনের আন্দোলনের দিকে। এই অর্জনের পেছনের রয়েছে অনেক ত্যাগ শিকার―অনেক ছাত্রযুবকের প্রাণহানি। শেখ মুজিবের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক মর্মব্যথাও ছিল। জেলে জুলুম নির্যাতন সহ্য করেছেন। দীর্ঘ কারাজীবনে ছেলেমেয়েরা বঞ্চিত হয় প্রিয় বাবার আদর-স্নেহ থেকে, স্ত্রী বঞ্চিত হন স্বামীর সোহাগ থেকে। বঙ্গবন্ধুর এই মর্মব্যথার তীব্রতা অনুমান করা যায় ১৯৬৯ সালের ২৪ ফ্রেব্রুয়ার পাকিস্তানে গোলটেবিল বৈঠকে যাওয়ার প্রাক্কালে ঢাকা বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের প্রদত্ত একটি বক্তব্যে। বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু সন্তানদের ছাড়া টানা ৬টি ঈদ কারাগারে কাটানোর কথা আবেগঘন ভাষায় উল্লেখ করেন। এ নিয়ে পরদিন ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯, দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল : ‘৬টি ঈদ গিয়াছে।’ প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, ‘লাহোরের পথে ঢাকা ত্যাগের প্রাক্কালে বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনাকালে শেখ মুজিবুর রহমান এক স্নেহময় পিতা হিসাবে তাঁর সন্তানদের প্রতি অপত্য স্নেহের পরিচয় দান করেন। বিমানবন্দরে তিনি বলেন যে, আমি তিনটি বৎসর কারাগারে ছিলাম এবং ছয়টি ঈদে আমার সন্তানেরা আমার সাহচর্য পায় নাই। এইবার আমি সন্তানদের সঙ্গে ঈদ করিতে চাই। শেখ মুজিবের এই উক্তিতে স্বভাবত অনুমান করা যায় যে, তিনি ঈদের পূর্বদিন ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করিবেন।’একাত্তরে পাকিস্তানের কারাগারে বঙ্গবন্ধুর ঈদ।
১৯৭১। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলছে। বর্ষপঞ্জির স্বাভাবিক নিয়মে সেবছরও বাঙালি মুসলমানের জীবনে এসেছিল পবিত্র রমজান মাস। মুসলিম বিশ্বে মাসটি যথারীতি পালিত হচ্ছিল ইবাদত-বন্দেগির মাস হিসেবে। কিন্তু বাঙালি মুসলমানরা মাসটি পার করেছে ভয়-উৎকণ্ঠা-অনিশ্চয়তা এবং বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতার মধ্যদিয়ে।যথারীতি দীর্ঘ একমাস রোজা শেষে ১৯ নভেম্বর সন্ধ্যায় ঈদের চাঁদ (শাওয়ালের চাঁদ) উঠেছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পশ্চিমাকাশে। পরদিন ২০ নভেম্বর শনিবার পবিত্র ঈদুল ফিতর; এমন বিবর্ণ, নিরানন্দ-বেদনা বিধুর ঈদ বাঙালি জীবনে আর কখনোই আসেনি। পাকিস্তানি হানাদারদের হত্যাযজ্ঞ, নিপীড়ন-নির্যাতনে বিপর্যস্থ পুরো বাংলা। শরণার্থী শিবির ও দেশের ভেতরে থেকে যাওয়া মানুষের ছিল আতঙ্ক এবং জীবনের চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে। মাতৃভূমিকে দখলদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত করতে রণাঙ্গনে সশস্ত্র লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন বীর বাঙালি। ঠিক এমন কঠিন বাস্তবতায় আসে ঈদুল ফিতর।
২০ নভেম্বর ১৯৭১, শনিবার বাঙালি মুসলমানের ইতিহাসে সবচেয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত ও দুঃখভরা ঈদটি বঙ্গবন্ধু কাটিয়েছিলেন পাকিস্তানের জেলে। তখন জেলে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান নানা অপতৎপরতায় লিপ্ত। টানা জেলে থেকে বঙ্গবন্ধু সময়ের হিসেবও অনেকটা হারিয়ে ফেলেন। ঈদের দিনে বঙ্গবন্ধুর মন ভারাক্রান্ত হয়েছে তাঁর প্রিয় বাঙালির জন্য। বাকিটা জানা যাক বঙ্গবন্ধুর বয়ানেই। ‘নিষ্ঠুর গণহত্যাকারীদের দয়ার উপর নির্ভরশীল বন্দির জন্য ঈদ এক নিষিদ্ধ স্বপ্নের মতো। আর আমি কোনো সাধারণ কয়েদি ছিলাম না, একনায়ক সরকারের ঘোষিত শত্রু আমি। তাই ঈদের দিনেও ওরা আমাকে সেল থেকে বের হতে দেয়নি। … মৃত্যুদণ্ডের অপেক্ষায় থাকা বন্দির অন্তিম ইচ্ছা পূরণের মতো জেলার আমাকে কিছু ফল পাঠিয়েছিলেন। ঈদের নামে এটা এক ধরনের রসিকতাও হতে পারে। কিন্তু আমার মনে পড়ে গেল দেশে আমার জনগণের কথা। বিষাদে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল হৃদয়।… অন্তরে রক্তক্ষরণ শুরু হলো। আমার প্রিয় জনগণ কীভাবে তাদের ঈদ উৎসব পালন করছে? এই প্রশ্ন আমি করলাম, জানি না কাকে! … আবার কখনো তাদের দেখা পাবো কি না সেটা না জেনেই, আমি মোনাজাত করে আমার জনগণের মঙ্গল ও নিরাপত্তা দয়াময় আল্লাহর হাতে সমর্পণ করলাম। এটাই ছিল আমার ঈদ। (সূত্র : আহমেদ সালিম, পাকিস্তানের কারাগারে শেখ মুজিবের বন্দিজীবন, পৃষ্ঠা : ৫৬)।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন আজন্ম দেশপ্রেমিক রাজনীতিক। তাঁর অস্তিত্বজুড়ে ছিল বাঙালির মুক্তি। একাত্তরের ঈদস্মৃতিতে দেখা যাচ্ছে তিনি নিজের পরিবারকে স্মরণে আনেননি, ভেবেছিলেন বাংলার জনগণের কথা। দেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃশংস গণহত্যার কথা তখনো তিনি জানতেন না। কিন্তু ২৫ মার্চ রাতে গ্রেফতারের আগে যে ধ্বংসযজ্ঞ দেখেছেন, এরপর বাঙালির ভাগ্যে কী ঘটতে পারে তা বঙ্গবন্ধু অনুমান করে নিয়েছেন। তাঁর মন জানিয়ে দিয়েছে―প্রাণপ্রিয় দেশবাসী ভালো নেই। এই ভেবে অন্তরে হয়েছে রক্তক্ষরণ। পাকিস্তানের জেলে থেকে বাংলার মানুষের জন্য দোয়া ছাড়া আর কিছু করার ছিল না তাঁর। তাই বাঙালির নিরাপত্তার ভার আল্লাহর হাতে তুলে দেন। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্যদিয়ে বাঙালির প্রাণপণ যুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধুর ঈদের দিনের প্রার্থনা কবুল করেন আল্লাহ, সফল হয় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালির ন্যায্য অধিকারের দীর্ঘসংগ্রাম।