MYMENSINGH BD NEWS24
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলায় আলোচিত চরিত্রের নাম জজ মিয়া। জজ মিয়া নামের এক যুবককে দিয়ে ঘটনার দায় স্বীকার করানো হয়। এ মামলার তদন্তে নিয়োজিত পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) তিন পুলিশ কর্মকর্তা জজ মিয়ার নামে ‘আষাঢ়ে গল্প’ ফাঁদেন। জজ মিয়া বলেন, সিআইডি কর্মকর্তারা তাঁকে বলেছিলেন, ‘তুই নিজে বাঁচ, পরিবারকে বাঁচা, আমাদেরও বাঁচা।’
জজ মিয়াকে কীভাবে আটক করা হয়, কীভাবে তাঁকে দিয়ে স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়, কী শর্তে তিনি তাঁদের প্রস্তাবে রাজি হন, আদালতে তা বলেছেন। ২০১৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ঢাকার ১ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে দেওয়া জবানবন্দিতে জজ মিয়া এসব কথা বলেন। ২১ আগস্ট গ্রেনেড বোমা হামলার ঘটনায় সাক্ষী হিসেবে তিনি এই জবানবন্দি দেন।
জজ মিয়া আদালতকে বলেন, ‘এসপি রশীদ সাহেব আমাকে সেনবাগ থানায় মারধর করেন। আমাকে রশীদ সাহেব বলেন, বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে গ্রেনেড হামলার সঙ্গে আমি জড়িত, সেই বিষয়ে যেন আমি স্বীকার করি। যদি স্বীকার না করি, তবে আমাকে ক্রসফায়ারে দেওয়া হবে। যদি স্বীকার করি, তবে আমাকে মারা হবে না। আমাকে তারপর চোখ বাঁধা অবস্থায় গাড়িতে করে নিয়ে আসে ঢাকায়। ঢাকায় নিয়ে আসার পর আমার চোখ খোলা হলে দেখি, আমি একটা রুমের ভেতর রয়েছি।’
২০০৫ সালের ৯ জুন নোয়াখালী থেকে জজ মিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়। তদন্তের নামে তাঁকে ১৭ দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে সিআইডি। পরে আদালতে ১৬৪ ধারার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় করা হয়। তদন্তের নামে ‘আষাঢ়ে গল্প’ ফাঁদেন মামলার তৎকালীন তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির এএসপি আবদুর রশীদ ও তৎকালীন বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন। সিআইডির এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমান তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর তিনিও সাজানো ছকে কথিত তদন্তকে এগিয়ে নিয়ে যান। এই গল্প সাজানোর ঘটনায় তদন্ত কর্মকর্তাদের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর।
জজ মিয়াকে ‘ক্রসফায়ারের’ ভয় দেখানো ও তাঁর পরিবারকে টাকা দান
জজ মিয়া আদালতে বলেন, ‘রশীদ সাহেব আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, আমি তাঁদের কথামতো রাজি আছি কি না। অন্যথায় আমাদের ক্রসফায়ারে দেওয়া হবে। আমাকে আরও বলা হয়, আমার মা, ভাই, বোন, অর্থাৎ, পরিবারের সদস্যদের ক্রসফায়ারে দেওয়া হবে। আমি বলেছিলাম, আমি ঘটনার সঙ্গে জড়িত নই। তখন আমাকে বলা হয় যেভাবে বলা হয়েছে সেভাবে স্বীকার করার জন্য। এসপি রশীদ সাহেব বলে, তাদের কথামতো কাজ করলে আমি ও আমার পরিবার বেঁচে যাব। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমাকে কীভাবে বাঁচানো হবে। আমাকে বলা হয়েছে, অমাকে এই মামলায় রাজসাক্ষী মান্য করা হবে। আমার পরিবার তারা দেখবে। পরবর্তীতে রশীদ সাহেব আমাকে তার বড় অফিসারের কাছে নিয়ে যায়। তার নাম বড় অফিসার রুহুল আমিন। রুহুল আমিন সাহেবও বলেন, “রশীদ সাহেব যেভাবে বলেছেন সেভাবে কাজ করার জন্য। তাতে আমার ও আমার পরিবারের ভালো হবে। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমাকে তো আসামি বানানো হয়েছে। এতে কি আমার ভালো হলো? তখন আমাকে জানানো হয়, আমাকে অত্র মামলায় আসামি করা হয় নাই। রাজসাক্ষী বানানো হয়েছে। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, রাজসাক্ষী হয়ে আমার কী হবে। তখন আমাকে জানানো হয়, রাজসাক্ষী দিয়ে কথামতো সাক্ষী দিলে আমার ভালো হবে। অন্যথায় “ক্রসফায়ারে” দিয়ে আমাকে হত্যা করা হবে।
‘আমি বলেছিলাম, আপনারা আমাকে বাঁচাতে পারেন, মারতেও পারেন। তখন রুহুল আমিন সাহেব বলে, বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে। আমাকে বাঁচতে হবে। আমার মা, বোন, ভাইকে বাঁচাতে হবে। তখন আমি পুলিশ অফিসারদের কথা রাজি হই। আমাকে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের গ্রেনেড হামলা মামলার ভিডিও দেখানো হয়। আমাকে কিছু ছবি দেখায়। পরে আমাকে বলে, যেভাবে আমাকে বলা হয়েছে, সেভাবেই আমি যেন আদালতে আমার বক্তব্য দিই।
‘রুহুল আমিনের রুমে আসেন মুন্সি আতিকুর রহমান। মুন্সি আতিকুর রহমান রুহুল আমিন সাহেবকে বলে, “জজ মিয়া কোনটি?” মুন্সি আতিক সাহেব আমাকে বলে, এরা ভালো লোক। এদের কথায় কাজ করলে আমার ভালো হবে। আমি বলেছিলাম, আমি রাজসাক্ষী হয়েছি। তাদের কথামতো জবানবন্দি করব। আমাকে দিয়ে অনেকের নাম বলানো হয়। আরও বলা হয়, ওই সব ব্যক্তিদের সঙ্গে আমাকেও দুই-একটি মামলায় জড়ানো হবে, যাতে লোকজন ঘটনা বিশ্বাস করে। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, আরও মামলায় আমাকে জড়ালে আমার কী হবে। তখন আমাকে জানানো হয়, মামলার বিষয়ে তারা ফাইট করবে। পরবর্তী সময়ে মুন্সি আতিক রুম থেকে চলে যায়। রুহুল আমিন সাহেব আমাকে বলে, “তুই নিজে বাঁচ, পরিবারকে বাঁচা, আমাদের বাঁচা।”
‘আমাকে সিআইডি মালিবাগ অফিসে হলরুমে নিয়ে যাওয়া হয়। রুহুল আমিন সাহেব হলরুমে সব অফিসারদের সামনে আমাকে দেখিয়ে বলে, আমি জজ মিয়া, আমি বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে ২১ আগস্ট গ্রেনেড মামলায় গ্রেনেড হামলা করেছি। অন্য কোনো অফিসার আমার সামনে কোনো কথা বলে নাই।
‘সিআইডি অফিসে থাকাকালে রুহুল আমিন সাহেবের মোবাইল ফোন দিয়ে সেনবাগ থানার কবির দারোগার মাধ্যমে আমার মা-বোনের সঙ্গে মোবাইলে কথা বলি। আমার মা তাদের সঙ্গে দেখা করলে রশীদ সাহেব আমার মাকে বলেন, সংসারের খরচ যা লাগে আমার মাকে দেওয়া হবে। মুন্সি আতিক আমার সঙ্গে জেলগেটে দেখা করেন। আমাকে বলা হয়, আমার কথা তারা রেখেছে, আমি যেন তাদের কথা রাখি। পরে মুন্সি আতিক সাহেব আবার জেল গেটে আমার সঙ্গে দেখা করে। সেখানে একজন আমাকে জিজ্ঞাসা করে, আমি কী জানি? তাঁর নাম কর্নেল গুলজার। তখন আমি তাঁকে বলি, রশীদ সাহেব, রুহুল আমিন সাহেব ও আতিক সাহেবের শিখিয়ে দেওয়া মতে স্বীকারোক্তি প্রদান করি। কর্নেল গুলজার সাহেব বলেন, ‘তারা সবাই অফিসার। আমাকে বাঁচানোর মালিক আল্লাহ। কর্নেল গুলজার মুন্সি আতিকুর রহমানকে বলে, “এ ধরনের নিরীহ আর কত মানুষের জীবন তারা নষ্ট করবে।”’
আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ শামসুল আলম বলেন, ‘২০০৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ডিআইজি হিসেবে সিআইডিতে যোগদান করি। একুশে আগস্ট গ্রেনেড বোমা হামলা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন এএসপি আবদুর রশীদ। তদারকি কর্মকর্তা ছিলেন এএসপি রুহুল আমিন। কোটালীপাড়ার মামলায় আসামি মুফতি হান্নানের নাম আসে। যার তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমান। আমার সিআইডি কার্যকালে এসপি রুহুল আমিন আমাকে জানায় যে জনৈক জজ মিয়া ২১ আগস্ট গ্রেনেড বোমা হামলার মামলায় জড়িত। পরে জজ মিয়াকে রশীদ ও রুহুল আমার সামনে হাজির করে। তারা দুজন জানায়, জজ মিয়া ঘটনার দায় স্বীকার করে স্বীকারোক্তি দিতে চায়। পরে তাঁরা আরও বলে, “জজ মিয়ার মা গরিব। তাকে আর্থিক সাহায্য দেওয়া প্রয়োজন।” কাজটি বেআইনি বলে তাকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করি। রুহুল আমিন আমাকে বলেন, “তিনি কাজটি গোপনে করবেন। কেউ জানবে না।” আমি বোঝানোর চেষ্টা করি, অবৈধ কাজ প্রকাশ্য ও গোপনে যেভাবেই করা হোক সেটি অবৈধ। তখন তিনি আমাকে জানান, “তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর বিষয়টি জানেন এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে বলেছেন। স্বীকারোক্তি প্রদানের ব্যাপারে তদন্ত ও তদারকি কর্মকর্তাগণ তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছিল।”’
জজ মিয়ার মা জোবেদা খাতুন আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে বলেন, ‘রুহুল আমিন সাহেব ও রশীদ সাহেব আমাকে বলে, জজ মিয়াকে একটি মামলায় রাজসাক্ষী বানানো হয়েছে। রাজসাক্ষী দেওয়ার পর তাকে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। আমাদের সংসার চালানোর চিন্তা করতে হবে না। তারা আমাদের চালাবেন।’
জজ মিয়ার বোন খোরশেদা আক্তার আদালতে বলেন, ‘রুহুল আমিন সাহেবের হাত-পা ধরে বলি, আমার বাবা নেই। জজ মিয়া আয়ের ওপর সংসার চলে। তাকে ছেড়ে দিন। তখন রুহুল আমিন সাহেব বলেন, তিনি আমার বাবার মতো। আমাদের সংসার চালাবেন। আমাকে লেখাপড়া করাবেন। রুহুল আমিন সাহেব আমাকে ও আমার মাকে গোশত দিয়ে ভাত খাওয়ান। আমার হাতে দুই হাজার টাকা দেন। আর মোবাইল নম্বর দেন। এসব কথা কাউকে না বলার জন্য বলেন। ছয় মাসে ১২ হাজার ৫০০ টাকা দেওয়া হয়। আমি সাংবাদিকদের বলেছিলাম, জজ মিয়াকে সিআইডি ধরে নিয়ে ঢাকায় রেখেছে। রুহুল আমিন সাহেব, আবদুর রশীদ সাহেব ও মুন্সি আতিকুর রহমান সিআইডি অফিসাররা টাকা দিয়ে আমাদের সংসার চালায়।’